সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার, উখিয়া নিউজ ডটকম।
প্রকাশিত: ১৪/০৮/২০২৫ ২:৫৪ পিএম


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে কক্সবাজার—যেখানে সোনালি সৈকতের সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের চোখে স্বপ্ন বুনে দেয়, সেই একই ভূমি সীমান্তের আঁধারে লুকিয়ে রেখেছে ভয়ঙ্কর এক মাদক সাম্রাজ্য। ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ, হেরোইনসহ নানা নেশাজাত দ্রব্য প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মূল্যে প্রবেশ করছে এই অঞ্চলের পথ দিয়ে। এই প্রবাহ কেবল তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে না, বরং দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ভীতও নড়বড়ে করে দিচ্ছে।

‘রেড করিডর’—মাদকের গোপন প্রবেশদ্বার :
মিয়ানমারের মংডু এলাকা থেকে ট্রলারে করে মাদক আনা হয় নাফ নদীর মাঝপথ পর্যন্ত। সেখান থেকে ছোট ডিঙি নৌকা বা শক্তিশালী স্পিডবোটে করে তা অতি দ্রুত টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্ত ঘাটে পৌঁছে যায়। পাহাড়ি গহ্বর আর কাঁচা রাস্তার আড়ালে গড়ে ওঠা গোপন পথে এই প্যাকেটগুলো ঢুকে পড়ে ভেতরের গুদামে। রাজধানীসহ বড় শহরে পৌঁছাতে ব্যবহার হয় পিকআপ, মাইক্রোবাস, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত। পুরো প্রক্রিয়ায় পাচারকারীরা মোবাইল ফোনে এমন কোড ভাষা ব্যবহার করে, যা অপরিচিত কানে অর্থহীন শোনায়—‘প্যাকেজ’, ‘মাছ’ বা ‘সিগারেট’ মানে আসলে ভয়ঙ্কর নেশা।

চক্রের চার স্তরের ক্ষমতার নেটওয়ার্ক :
মাদক সাম্রাজ্যের পেছনে রয়েছে এক জটিল ও বহুস্তরীয় কাঠামো। এর শুরু সীমান্তের ওপারে, যেখানে মিয়ানমারের মাদক সম্রাটরা আড়ালে থেকে সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। সীমান্তের এই পাশে কাজ করে স্থানীয় ফিনান্সাররা, যারা প্রভাবশালী এবং বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে মাদক ঢাকাসহ দেশের বড় শহরের চক্রে সরবরাহ করে। এরপর পাইকারি পরিবেশকেরা গুদাম ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে, নিয়মিত রুট বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে চলে। সর্বশেষ ধাপে খুচরা বিক্রেতারা শহরের অলিগলিতে যুবকদের হাতে তুলে দেয় মাদকের প্যাকেট। অর্থ, অস্ত্র আর প্রভাবের জোরে এই চক্র নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখে বছরের পর বছর।

সমাজে অদৃশ্য ক্ষত :
মাদক ব্যবসা সমাজের গোপন শিরায় বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কালো টাকার পাহাড় গড়ে বৈধ অর্থনীতিকে বিকৃত করছে, স্কুল-কলেজের বেঞ্চ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে নেশায় হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের কারণে। অপরাধের হার বাড়ছে, চুরি-ছিনতাই থেকে খুন পর্যন্ত অনেক অপরাধের পেছনে পাওয়া যাচ্ছে মাদকাসক্তদের সংশ্লিষ্টতা। পারিবারিক জীবনে আসছে ভাঙন, নেশাগ্রস্ত সদস্যের কারণে বাড়ছে সহিংসতা ও বিচ্ছেদ। স্থানীয় এক সমাজকর্মী আক্ষেপ করে বলেন, “মাদক শুধু একজন যুবককে ধ্বংস করে না, তার পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।”

বিজিবির পাল্টা অভিযান—অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কৌশল :
২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজার রিজিয়ন বিজিবির হাতে ধরা পড়েছে এক ভয়াবহ পরিসংখ্যান। এই সময়ে উদ্ধার হয়েছে ২ কোটি ৯০ হাজারের বেশি ইয়াবা, প্রায় ৩৮১ কেজি ক্রিস্টাল মেথ, ২৫ কেজির বেশি হেরোইন, ৫২ কেজির বেশি গাঁজা, হাজার হাজার ক্যান বিদেশি বিয়ার, বোতলভর্তি বিদেশি মদ, কোকেন ও আফিম। সব মিলিয়ে যার বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৯৩ কোটি টাকায়। উদ্ধার হয়েছে ১২ কোটির বেশি নগদ অর্থ এবং গ্রেফতার হয়েছে ২,৬৩৯ জন, যাদের মধ্যে বহু বছরের পাকা পাচারকারীও রয়েছে।

বিজিবি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, সীমান্তের দুর্গম ভূগোল, স্থানীয় সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত ঘাটতি এই লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলছে। তবুও নতুন নজরদারি ড্রোন, থার্মাল ক্যামেরা ও স্পিডবোট ব্যবহারের মাধ্যমে পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা চলছে।

জনসম্পৃক্ততা ছাড়া যুদ্ধ অসম্ভব :
বিজিবি দৃঢ়ভাবে বলছে—এটি শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, এটি মানুষের যুদ্ধ। সাধারণ মানুষ মাঠে না নামলে মাদক পাচার ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই স্কুল-কলেজে সচেতনতা কর্মসূচি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে জনগণকে এই যুদ্ধে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে।

সাফল্য ও প্রতিজ্ঞার মঞ্চ :
১৩ আগস্ট সকাল ১১টায় কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির প্রশিক্ষণ মাঠে মাদকবিরোধী সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আকসার খান। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নাজমুল হোছাইন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম, পুলিশ সুপার মো. সাইফুদ্দিন শাহীন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নাহিদ হাসান সৌরভ।

সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই সভায় উচ্চারিত হয় এক অঙ্গীকার—যত কঠিনই হোক, সীমান্তের অন্ধকার মাদক সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করতেই হবে।

পাঠকের মতামত

ব্র্যাকের আয়োজনে ‘যুব ক্যারিয়ার ভাবনা’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত

যুবদের দক্ষতা উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার তাগিদ বিশিষ্টজনদের দেশে চাকরির তুলনায় চাকরিপ্রত্যাশীর সংখ্যা ...

দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনসীমান্তে ডজনখানেক সশস্ত্র আরাকান আর্মির অবস্থান, বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায়

সোমবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির (এএ) এক সশস্ত্র সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ...